রেগে গেলে মানুষ কেন হেরে যায় জেনে নিন। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।

২০০৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ, ফাইনাল ম্যাচে ইতালির ডিফেন্ডের মার্কোমাকারোজি লেন্সের মেজাজ হারিয়ে ফেললেন ফ্রান্স এর ক্যাপটেন জিনেদুল জিদান।

ফুটবলের বদলে ঢুস দিয়ে বসলেন মাকারোজির বুকে। ফলাফল পুরো টুনামেন্টে পারফরম্যান্স এ টুঙ্গে। জীবনের শেষ বিশ্বকাপ শেষ করলেন অসম্মানজনক ভাবে লাল কার্ড দেখিয়ে।

ফ্রান্স হাড়ালো বহুল প্রত্যাসিত বিশ্বকাপ। জিদান হাড়ালেন দেশকে দ্বিতীয় বারের মতো কাপ জেতানোর বিরল সৌভাগ্য।

নিন্দা, অপমান, হতাশা আর সুযোগ হারানোর সবকিছুর নেপথ্যে ছিল রাগ।

একটু চিন্তা করলেই দেখবেন। আপনি হয়তো জীবনে বহুবার বহুভাবে হেরেছেন। শুধু রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পাড়ায়।

কিন্তু রেগে গেলে মানুষ হেরে যায় কেন।
এর মনদৈহিক ব্যাখ্যা কী?

আমরা যখন রেগে যাই তখন ব্রেনের এমিগডালা অংশটি মনে করে, আমরা মনেহয় কোন বিপদে পড়েছি।
তখন সে ব্রেনের হাইপোথ্যালামাস কে জানান দেয়, এই বিপদের জন্য তৈরি হতে হবে।

হাইপোথ্যালামাস জানান দেয় পিটুইটারি গ্লান্ড কে যেন সেখান থেকে কর্টিসল, অ্যাড্রিনালিন, নরএপিনেফ্রাইন ইত্যাদি হরমোনগুলো নিঃসরণ হয়। যা দিয়ে এই বিপদ বা স্ট্রেস কে মোকাবেলা করা যাবে।

  • ফলে শরীরে তৈরি হয় একটা টান টান অবস্থা।
  • রক্তচাপ বেড়ে যায়।
  • হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়।
  • হাত ও পা এর পেশিতে তৈরি হয় বাড়তি সক্রিয়তা।

রাগি মানুষ কেন কোথা শোনার আগেই হাত চালিয়ে দেন।

বীর রস্তম, সৌরভ সম্পর্কে তারা পিতা পুত্র। সৌরভ জানতেন তার বাবা বিখ্যাত বীর রস্তম, কিন্তু চেহারায় ছিল তার রাগ, আর রস্তম তো কখনই জানতে পারেন নি তরুন বীর সৌরভ এর বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়েছেন, সে আসলে তারই ঔরসজাত পুত্র।

সৌরভ একবার দুধ পাঠিয়ে জানানোর উদ্যেগ নিয়েছিলেন বটে। দুধের মুখেই সৌরভ নামটি শুনেই হত্যা করেছিলেন উত্তেজিত রস্তম। দুজনের মধ্যেই শুরু হলো মল্য যুদ্ধ। সৌরভ রস্তম কেউ কাউকে চেনেন না।

প্রবল এবং দীর্ঘ যুদ্ধে পরম শত্রু ভেবে যাকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে, সে তারই বাবা এবং ছেলে। কেউ জানতে পারেনি সেকথা।

এর মধ্যে বীর নীতি লঙ্ঘন করে, মল্য যুদ্ধে সৌরভ কে ছুরির আঘাত করলেন রস্তম। মৃত্যুর কলে ঢলে পড়ার আগে সৌরভ বলে গেলেন তার শেষ কথা।

তুমি জান আমি কার ছেলে। মহাবীর রস্তম, আমার পিতা রস্তম যদি জানতে পারেন যে, তুমি বীর নীতি লঙ্ঘন করে তার পুত্রকে হত্যা করেছ। তাহলে তুমি তার হাত থেকে বাচতে পারবে না।

কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। রাগে অন্ধ রস্তমের নিজের হাতে খুন হলো নিজের ছেলে।

আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশটি কপালের মধ্যভাগে অবস্থিত, তার নাম প্রি-ফ্রন্টাল কটেক্স।

  • সিদ্ধান্ত গ্রহন।
  • পরিকল্পনা প্রনয়ন।
  • এবং ভাল মন্দের এর ফারাক।
  • ও কাজের পরিনাম বোঝার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে এই অংশটি।
রেগে গেলে এই অংশের কার্যক্ষমতা কমে যায় ফলে। ভুল করেন এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেন।

এজন্যই চীনা প্রবাদ বলে রাগান্বিত অবস্থায় কখোনও চিঠি লিখতে বসো না।

  • সম্রাট চেংগিসখানের ছিল এক পোষা বাজ পাখি। আগের দিনে শিকারী রা শিকারের সময় প্রশিক্ষিত বাজ পাখি সাথে রাখে।
  • শিকারীর চোখের ইশারা পেলেই বাজ পাখি উড়ে যেত আকাশে। খরগোশ বা হরিণ দেখতে পেলে নেমে আসতো। আর তাকে দেখে শিকারী ও তীর ধনুক নিশানা করতেন। তো এই বাজ পাখিটি ছিল চেংগিশখানের খুব প্রিয়।
  • শিকারে গেলেই তিনি তাকে সাথে রাখতেন। একবার জঙ্গলে শিকারে গিয়ে কোন কারনে চেংগিস খান দলছুট হয়ে পড়েছিলেন।
  • নিজের ঘোড়া আর বাজ পাখি এই দুটি ছাড়া, আর কেউ ছিলনা তার সাথে।
  • পথ যদিও চেনা ছিল কিন্তু দূর্গম পথে আসতে তার বেশ সময় লাগছিল, এমন সময় প্রচন্ড পিপাসা পেল তার, এইদিকে দাবুদাহি, ঝিলি, নালা সব শুকিয়ে গেছে।
  • উচু এক ঝরনা থেকে কোন রকমে চুইয়ে পানি পড়ছে অল্প অল্প করে।
  • নিজের পাত্রটা বের করে পানির সামনে ধরলেন। পানি পাত্রের মধ্যে পড়তে লাগলো।
  • বেশ অনেকক্ষণ পর যখন পাত্রে পানি জমা হলো এবং পানি পান করার জন্য মুখ লাগাতে যাবেন এমন সময় বাজ পাখিটি উপর থেকে উরে এসে ছো মেরে ফেলে দিল পানি।
  • সম্রাট ভাবলেন পাখিটা বুজতে পারেনি। উরার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলেই এমন হলো।
  • দ্বিতীয় বার পাত্র ভরলেন, দ্বিতীয় বার ও একি অবস্থা বাজ পাখি ঝাপটা দিয়ে ফেলে দিল পানি।
  • তৃতীয় বারও যখন একি ব্যাপার ঘটলো, সম্রাট তখন খুবি ক্রুদ্ধ হলেন।
  • এরপরে তিনি তরবারি বের করে রাখলেন, এবার যদি বাজ পাখি আসে তাহলে এক কোপে তার কল্লা কেটে ফেলবেন। হলোও তাই।
  • এবার যখন পানি ফেলে দেওয়ার জন্য বাজ পাখি আসে তখন চেংগিস খান বাজ পাখির শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেললেন এক নিমিষেই।
  • এরপর সম্রাটের রোগ চেপে গেল যে করেই হোক পানি তিনি খাবেন। ঘোড়া নিয়ে খারা উঠতে শুরু করলেন পাহাড়ের মাথায়, যেখান থেকে ঝরনা টা বইছে।
  • অনেকক্ষণ পর যখন শেষ মেস উঠলেন, দেখেন প্রকান্ড এক বিষধর সাপ মরে পড়ে আছে। জমাট পানিতে। আর তার বিষ মিশছে ঝরনার পানিতে।
  • এই বিষাক্ত পানি খেয়ে সম্রাট মারা না জান, সেজন্যই বাজ পাখি বার বার পানি ফেলে দিচ্ছিলো। অনুশোচনায় জর্জরিত সম্রাট।

নিজেকে বলতে লাগলেন আজ শিখলাম, রাগের মাথায় কখনো কোন সিদ্ধান্ত নিতে নেই।

একটা ব্যাপার হয়তো আপনি খেয়াল করেছেন যে, রাগের মূহুর্তে এমন অনেককিছুই আপনি বলেন, যার কথা পড়ে আর মনে থাকে না।

কেন জানেন মস্তিষ্কের গুরুক্তপূন্য অংশ হিপোকেম্পাস ধীর হয়ে যায়।

হিপোকেম্পাস এর অন্যতম কাজ হলো। স্মৃতি ধরে রাখা, ও নতুন স্মৃতি তৈরি করা। ফলে সবসময় যারা রেগে থাকেন দেখবেন তাদের স্মৃতিশক্তি ও কম।

প্রকাশিত রাগের পাশাপাশি অপ্রকাশিত রাগ মানে ক্ষোভ – ঘৃনার ক্ষতিও কম নয়। বলা হয় ক্ষোভ এমন একটি বিষ, যা আপনি নিজে পান করেন, আসা করছেন মারা যাবে আপনার প্রতিপক্ষ।

 

একবার এক বিষধর সাপ চলার পথে হটাৎ তরবারির ধারালো অংশের সাথে তার শরীর লেগে যায়।

ব্যাথায় কুকরে উঠে সে। ক্ষেপে গিয়ে তৎবারিকে আঘাত করতে যায় সে, আবার ও ব্যাথা পেল। খানিকটা কেটেও গেল, এরপর সে আরো রেগে গিয়ে শত্রু মনে করে পেচিয়ে ধরতে গেল। অমনি তরবারির ধারালো আঘাতে খন্ড বিখন্ড হয়ে গেল তার দেহ।

অথাৎ, রাগ বা ক্ষোভ এটা অন্যের চেয়ে আপনার বেশি ক্ষতি করে। সম্পর্কে তৈরি করে স্হায়ী ক্ষত। সুযোগ নষ্ট হয়, জীবনে আসে রোগ, শোক, হতাসা ব্যর্থতা।

আর জীবন যুদ্ধের প্রতিটি ক্ষেত্রেই হেরে যেতে থাকেন আপনি।

Tw3press

My name is Masudur Chowdhury I'm an Management and Engineering Consultant with more than 7 years of experience.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *